ড. এজাজ মামুন» কৃষিকে বাংলার প্রাণ বললে ভুল হবে না। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণ করা কৃষিকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। এটা কোনো আবেগের কথা নয়, বাস্তবতা। যাদের ঘামে ও মায়ায় আমাদের শস্যের ক্ষেত সবুজ থেকে সোনালি হয়ে ওঠে, আমাদের খাবারের থালায় অন্নের জোগান আসে—এবছর উপর্যুপরি ফসলের রোগ এবং পরে বন্যায় তারা অনেকেই আজ দিশেহারা। প্রথমে হাওর ও পরে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নদীপারের কৃষকরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা এখন প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ে ঘটে যাওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য। এবারের বন্যায় ক্ষতি শুধু কৃষকের মাঠে ঘটেনি—অসংখ্য কৃষক তাদের বসতবাড়ি হারিয়েছেন, পুকুরের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। গবাদিপশু হাঁস-মুরগি মরে গেছে, ছোট খামারিরা তাদের খামার হারিয়েছেন, ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র গ্রামীণ শিল্পের। সঠিক পরিসংখ্যান জানা না গেলেও গ্রামাঞ্চলে এবারের বন্যার ক্ষতি অপরিসীম। সরকারি হিসাবমতে সারাদেশের ৪০টি জেলায় সাড়ে বায়ান্ন হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে।
বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন সঠিকভাবে না হলে নিশ্চিত করে বলা যায়, এর ফলে আমাদের উন্নয়নধারা ব্যাহত হবে। সরকার পুনর্বাসনে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতির পরিমাণ ও পরিসংখ্যান, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি পুনর্বাসন পরিকল্পনা আমাদের চোখে পড়েনি। পত্রিকা ও সরকারের কিছু বক্তৃতা-বিবৃতিতে এটুকু আমরা বুঝেছি যে এবছরের তলিয়ে যাওয়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া আমনের নতুন চারা বিতরণ এবং কিছু কিছু জায়গায় বিকল্প ফসল উত্পাদনের জন্য সরকারের কৃষিবিভাগ জোরালো পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অল্প সময়ে বেশ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। সরকারের কৃষিবিভাগের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি রোপা আমন ধানের চারা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে অনেক এলাকায় কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন। খবরের কাগজে এ ধরনের বেশ কিছু রিপোর্ট এসেছে। যেসব কৃষক সরকারের সহায়তায় ধানের চারা সংগ্রহ করতে পারেননি অনেক এলাকায় তাদের বেশি দামে চারা সংগ্রহ করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বন্যায় দেশের ৩১টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য ১১৭ কোটি টাকার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে সরকার। কৃষকদের মাঝে প্রণোদনা হিসেবে দেবার জন্য ৫৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। বন্যায় কৃষকদের ক্ষতির তুলনায় এই বরাদ্দ যে যত্সামান্য তা সরকারকে বিবেচনায় আনতে হবে। এবার বন্যার কারণে বানভাসি কৃষকরা ডিসেম্বরে ফসল ঘরে আনতে পারবেন না। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এপ্রিল পর্যন্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় পড়তে পারেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা-পরবর্তী এ ধরনের ঘটনা অনেকবারই ঘটেছে। এজন্যে সরকারকে এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধুমাত্র আমন চাষের ও কিছু বিকল্প পরিকল্পনায় যেন এই পুনর্বাসনের সব কাজ শেষ হয়ে না যায়, কৃষক যেন আগামী দিনগুলোতে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারেন সেদিকে নজর দিতে হবে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে এগোতে হবে। পর্যাপ্ত প্রণোদনাসহ বানভাসি কৃষকদের বিনা সুদে সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। দানা ফসলের সাথে সহজে বেশি মুনাফা আসতে পারে এমন সবজি, ফল, মত্স্য, পশুপালনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ ও সহায়তা দানে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
এবারের বন্যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবাদিপশু ও মত্স্য খামারের ক্ষতি হয়েছে। অনেক খামারি পথে বসেছেন। বন্যায় ফসলের ক্ষতির পুনর্বাসনের সাথে সাথে গবাদিপশু ও মত্স্য চাষিদের ক্ষেত্রেও যথাযথ পুনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাদের জন্যও প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। আমাদের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। খবর এসেছে অনেক এলাকায় গবাদিপশুর খাবারের সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারকে এই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় আনতে হবে এবং গবাদিপশুর জন্য ঘাসের বিকল্প খাবারের ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকার চাল আমদানি করে দেশের খাদ্য ঘাটতি মেটাবার ব্যবস্থা নিয়েছে এবং সাড়ে ছয় লাখ টনের অধিক খাদ্য মজুত আছে বলে জানিয়েছে। চাল আমদানি যেন কোনোভাবেই কৃষকদের স্বার্থহানির কারণ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। বন্যার কারণে এবার কৃষকরা অন্য বছরের থেকে বেশি বিনিয়োগ ও শ্রম দিয়ে ফসল উত্পাদন করছেন। কৃষকরা যেন তাদের ফসলের যথাযথ দাম পান সেটা এখনই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তাছাড়া এক বন্যার ক্ষতি শুধু এক ফসলের বা বছরের পুনর্বাসনের পরিকল্পনায় পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্যে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্বাভাস ও মোকাবিলায় দেশকে আরো বেশি প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। এল নিনা, লা নিনোসহ আবহাওয়া পূর্বাভাসের ইন্ডিকেটরগুলো পর্যবেক্ষণ, বিকল্প ব্যবস্থা ও বাফার কৃষি উপাদান সরবরাহের সবরকম ব্যবস্থা বন্যা-খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের আরো বেশি শক্তিশালী করতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে জয় করার অদম্য দক্ষতা রয়েছে আমাদের দেশের কৃষকের। আমাদের সবচে’ বড় অর্জন খাদ্য স্বয়ংসম্পূূর্ণতা এনে দিয়েছে কৃষকের বেঁচে থাকার প্রাণান্ত যুদ্ধ। আমরা জানি, কৃষকদের বন্যা-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিবান্ধব এই সরকার যে তাদের পাশে থাকবে তাতে কোনো সংশয় নেই।
লেখক :প্রবাসী কৃষি বিজ্ঞানী, উপ-সম্পাদকীয়, দৈনিক ইত্তেফাক