সৃষ্টির আদি পেশা কৃষির সূচনা হয়েছিল নারীর হাত দিয়ে। নারী ঘরকন্যার পাশাপাশি সামাল দিত কৃষি। পরবর্তীতে গ্রামীণ সমাজে পুরুষরাই কাজ করত মাঠে আর নারীরা রান্নাবান্না আর সন্তান লালন-পালন নিয়েই ব্যস্ত থাকত। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে কৃষিকাজে এগিয়ে এসেছে নারীরা। তারা পুরুষের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে ধানের বীজ বপন থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, ধান কেটে ঘরে তোলাসহ সব কাজ তারাই করছে। অনেকে আবার বাড়ির পাশে কিংবা উঠানে অনাবাদি জায়গায় শাক-সবজি, ফলফলাদির আবাদ করে সংসারে বড়তি রোজগারের পথ করে নিচ্ছে। এতে পরিবারের খরচ মেটানোর পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।
দেশের চা শিল্পের মতো সমৃদ্ধ খাতের পেছনে নারী চা শ্রমিকদের বিশাল অবদান রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়ি চাষ, হাঁস-মুরগি পালন থেকে শুরু করে কৃষির প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবদান রয়েছে। আমাদের দেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আর নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। ফসলের প্রাকবপন থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ পর্যন্ত বেশির ভাগ কাজ নারীকে এককভাবেই করতে হয়। এ ছাড়া ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি সবজি চাষ, মসলা উৎপাদন, শুঁটকি ও নোনামাছ প্রক্রিয়াকরণ, মাছ ধরার জাল তৈরি, মাছের পোনা উৎপাদনের কাজও নারীরা করে থাকে। বসতবাড়িতে সামাজিক বনায়ন, গবাদিপশু ও হাঁসমুরগি পালনের কাজও করে নারীরা। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও হয় না।
এখন গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রতিদিনের কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। পুরুষ শ্রমিকের সমপরিমাণ কাজ করেও কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। এ ছাড়া নিয়মহীন নিযুক্তি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, স্বল্প মজুরি, মজুরি বৈষম্য এবং আরো নানা ধরনের নিপীড়ন তো রয়েছেই। নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক শ্রমিক। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরেই থেকে যায়। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই।
অথচ এ সময় কৃষি খাতে পুরুষ শ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে প্রায় ১১ শতাংশ। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য কৃষিতে নারী শ্রমিক বা কৃষাণীর অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী যারা কাজের সঙ্গে জড়িত অথবা কাজ করছে না কিন্তু কাজ খুঁজছে এমন জনগোষ্ঠীকে শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। সরকারি তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ কর্মসংস্থান। শ্রমশক্তির হিসাব অনুযায়ী ৩০ শতাংশ নারী কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাকিরা অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই থাকছে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছে।
এদের বিরাট অংশ কৃষাণী, কিন্তু শ্রমশক্তির বিবেচনায় তা অদৃশ্য। দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতথ্য থাকলেও কৃষাণীদের কোনো সংখ্যাতথ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কাছে নেই। রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে প্রদত্ত ১ কোটি ৩৯ লাখ ‘কৃষক কার্ড’ বিতরণ করা হলেও কতজন কৃষাণী এ ‘কৃষক কার্ড’ পেয়েছেন- সংশ্লিষ্টরা তা জানেন না। কম মজুরি সত্ত্বেও অন্য কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় এবং ঘরের কাজের পাশাপাশি কৃষিকাজেও অংশ নেয়া যায় এসব কারণে প্রামীণ নারীরা কৃষিতে শ্রম দিচ্ছেন, যার অধিকংশই মজুরিবহির্ভূত পারিবারিক শ্রম। নারী কৃষি শ্রমিকদের শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষক হিসেবে তার প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিও শ্লথ হয়ে পড়বে। কর্মজীবী নারী সংগঠনের নেতারা কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি শ্রম কমিশন গঠন করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। কৃষকের অধিকার আদায়ে কৃষিশ্রম আইন প্রতিষ্ঠা, সে সঙ্গে একটি কৃষি কমিশনও গঠন করতে হবে। তাদের মতে, কৃষি খাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টিতে। অথচ কৃষিকাজে নারীর স্বীকৃতি নেই। আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়ের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। তারা নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র দান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষি শ্রমিক তথা কৃষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।
বিশ্বব্যাংক পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদন ২০১২ অনুযায়ী অর্থনীতিতে নারীর অবদান সম্পর্কে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা- সব মিলিয়ে এগিয়েছে মানব সভ্যতা। যাদের অর্ধেক অবদানে আজকের এ সভ্যতা, সেই নারীর অবস্থার পরিবর্তন এখনো অনেক বাকি। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নারী এখনো পিছিয়ে রয়েছে। সামগ্রিক কাজের ৬৬ শতাংশ করে নারী, খাদ্যের ৫০ শতাংশও তারাই উৎপাদন করে অথচ তারা পায় কর্মের মাত্র ১০ শতাংশ।
এমনকি তাদের মালিকানায় রয়েছে বিশ্বের মাত্র ১ শতাংশ সম্পত্তি। ১৪১টি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়ে নারীর অবস্থার এ চিত্র পাওয়া যায়।
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে তাদের উন্নয়ন ছাড়া দেশের সার্বিক উন্নয়ন অসম্ভব। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরো বাড়বে।
:: শান্তনু শেখর রায়
ভোরের কাগজ